ভালোবাসার গল্প : বিষন্ন শুকতারা

ভালোবাসার গল্প : বিষন্ন শুকতারা  

লিখেছেন : নীল অর্ধবৃত্ত

মরীচিকায় আধো ঘেরা একটা লোহার তার । আর সেটা থেকে চুয়ে চুয়ে বৃষ্টির পানির ফোটা পরছে।

কি চকচকে ও পরিষ্কার দেখাচ্ছিল সেই লোহার তারটাকে পানির ফোটার জন্য, কিন্তু এই পানির ফোটার জন্যই আজ ওটার গায়ে মরীচিকা ধরেছে। বারান্দার অপরিষ্কার চেয়ারটায় বসে ফোটাগুলো গোনার বৃথা চেষ্টা করছিল রক্তিম। কিন্তু কেন যেন বার বার গুলিয়ে ফেলছে।
*
রক্তিম তার বাবা-মার একমাত্র সন্তান।
তার বাবা-মা তাকে লেখাপড়া করার জন্যে ঢাকা শহরের এক হোস্টেল নামক কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। অবশ্য তাকে ঢাকায় পাঠানোর আরো একটা কারন আছে। সেটা হচ্ছে তার জন্মস্থানের পরিবেশ খুব একটা সুবিধের ছিল না। পুরু এলাকাটা ছিল চোর, বাটপার, ছিনতাইকারী আর খারাপ ছেলেপোলোয় ভরপুর। রক্তিম খুব দুরন্ত ছিল বিধায় তাকে তার বাবা-মার চিন্তা ছিল সেও কিনা এই চোর-ছেচ্ছরদের পাল্লায় মিশে খারাপ না হয়ে যায়। আর সে জন্যেই রক্তিমকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।

রক্তিম তখন তেমন বড় হয় নি। দেখতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা ছাত্র হলেও সবে পড়ছে ক্লাস নাইনে।হোস্টেল দেখে সে প্রথমে খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু মায়ের চলে যাওয়ার সময় খুব ব্যথা অনুভব করেছিল বুকের বা পাশটায়।

ছোট হলেও ছেলে মানুষ তো তাই মাকে বলতে পারিনি, মা তুমি যেও না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি চলে গেলে কে আমকে খাওয়ার জন্য বকাবকি করবে। শেষমেশ না পেরে কে খাইয়ে দিবে!!

না, পারেনি রক্তিম কিছুই বলতে পারেনি। শুধু উল্টোফিরে একফোটা চোখের জল ফেলেছিল। আর ছেলে মানুষ তো তাই একফোটার বেশি ও আর চোখের পানি ফেলতে পারে নি।

তারপর শুরু হলো কঠিন আর জীবনের চরম ব্যর্থতার জীবন….

*
একদিন বিকেল স্কুলের বাস্কেট গ্রাউন্ডে একাএকা খেলছিল রক্তিম। হঠাত কে যেন পিছন থেকে তার হাত থেকে কায়দা করে বলটা কেড়ে নেয়। সে দেখল তার চেয়ে একটা জুনিয়র ছেলে তার হাতের বলটা নিয়ে খেলছে। ছেলেটা জুনিয়র হলেও দেখতে একটা ছোট্ট খাট্ট হাতির বাচ্চার সমান। তাই সে ভাবল কাড়াকাড়ি করলে বলটা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি অতএব ভালভাবে চাওয়াটাই শ্রেয়। কিন্তু না ছেলেটাকে ভালভাবে বলায় বলটা দিল না। তারপর কিছুনা ভেবেই কেড়ে নিতে চাইল বলটা রক্তিম। কিন্তু গায়ের জোরে পেড়ে উঠেনি সে। কিন্তু সে নাছোরবান্দা। বল সে নিয়েই ছাড়বে সে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন! হোস্টেল এর উপর থেকে কে যেন দেখছিল ব্যপারটা। রক্তিম দেখতে পেরে একসময় নিশ্চুপ হয়ে সেই জায়গা ত্যাগ করে।
*
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত যখন ৮টা, রক্তিম রুমে বসে অংক হোমওয়ারক করছিল।
হঠাত এক সিনিয়র ভাইয়া এসে রক্তিমকে বলল-

_এই তোমার নাম রক্তিম ?
_জি, ভাইয়া।
_ও, তোমাকে ধ্রুব ভাই ডেকেছে। তাড়াতাড়ি আস!
এই বলে সেই ভাইয়া চলে গেল।

ধ্রুব ভাই হচ্ছে এই হোস্টেলের প্রধান। হোস্টেল শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তাকে হোস্টেলের সবকিছু দেখাশুনা করতে হয়।
আর তাকে সেই জন্যে একটু সবাই মেনে চলতে বাধ্য।

কিছুক্ষন পর_
রক্তিম হেঙ্গার থেকে তার সাদা শার্টটা গায়ে চেপে খুব ভয়ে ভয়ে ধ্রুব ভাইয়ার রুমে ঢুকল।

_হ্যা রক্তিম বাবু আসেন আপনি, এখানে আসেন।

রক্তিম ধীরে ধীরে ধ্রুব ভাইয়ার সামনে গেল…

_আপনিই তো রক্তিম ,তাই না?

_জি ভাইয়া আমিই রক্তিম, আমাকে হঠাত এখানে ডেকেছেন কেন ভাইয়া?

ধ্রুব ভাইয়ার পাশে তার কয়েকটা বন্ধুও বসা ছিল। তারা কিযেন বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে।

_তা বাবা, দেখতে তো খুব ভদ্রই লাগে, কিন্তু হোস্টেলে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝগড়া শুরু কইরা দিলা কেন!!

_ভাইয়া আআআআআ…মি ঝগড়া করতে চাইনি, সে নিজে এসে আমার কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়েছিল। আমি অনেকবার বলেছিলাম তাকে ভাল করে বলটা দিয়ে দেবার জন্য, কিন্তু সে দেয়নি। উলটো আমার সাথে বল নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করেছিল।

_তো তুমিও তার সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলে তাই না!!

_আমি ভাল করে চাইবার পরেও সে দেয় নি, তো কি করব বলুন??

_চুপ বেয়াদপ কোথাকার!!! বল দিবে না বলে কি ঝগড়া করতে হবে নাকি। আর আচ্ছা তুমি যে ওর সাথে লাগতে গেস, তুমি পারবা ওর সাথে। তুমি তো সিনিয়র, তোমাকে যদি ছোট হয়ে একটা নাকের মধ্য ঘুসি বসিয়ে দিত তাহলে তোমার সম্মানটা কি থাকত।

এই কথাগুলা বলা শেষে ধ্রুব ভাইয়া বসে কি ব্যাঙ্গার্থকভাবে হাসছিল ঐ জুনিয়রটার সামনে।

রক্তিম খুব ছোট হলেও তাকে যে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করা হচ্ছে সে ওটা ভালোই বুঝতে পারছিল। অতপর, রক্তিম আর কিছু বলল না, বরং মাথা নিচু করে ছল ছল চোখে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
*
ঐদিনের পর থেকে রক্তিমকে কারো সাথে কথা বলতে দেখা যায় নি। হোস্টেলে সে একটা ভোবাপ্রানীর মত জীবনযাপন করা শুরু করছিল। আর প্রত্যেকদিন বিকেলবেলায় হোস্টেলের তিনতলার মসজিদের সামনে বসে একদৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকত। হয়ত তার মায়ের আসার জন্যই অপেক্ষা করত সে। রক্তিমের রোমম্যাট কামরুল, রক্তিমের এই আকস্মিক পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছিল।

একদিন মাঠের এক কোনায় রক্তিম একা বসে আনমনে খেলা দেখছিল। হঠাত কাধে কার যেন হাত পড়ে পিছন থেকে, পিছন ফিরে দেখে কামরুল।

_কিরে এখানে একা একা কি করছিস?

_কিছু না, বসে আছি এমনেই!!

_ও আচ্ছা , তো চল খেলতে যাই এখানে বসে থেকে কি করবি।

এই বলে কামরুল রক্তিমের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল…

ঐদিন কামরুলের জোড়াজোড়ির ফলে রক্তিমের মুখে খেলাচ্ছলে একটু হাসি দেখা গিয়েছিল। রাতে খাবার পর কামরুলের সাথে অনেক কথা হয় রক্তিমের। কিছুদিন এভাবে রক্তিমকে আবার একটু সজিব হতে দেখা যায়। কিন্তু রক্তিমের ভাগ্যে যে সুখ-আনন্দ বেশিদিন খাপ খাইতে পারে না সেটা সে বুঝেছিল কামরুলের রুম পরিবর্তনের সময়।

রক্তিম আবার একা হয়ে যায়, ধীরে ধীরে তার একটা খিটখিটে আর পাগলাটে স্বভাব দেখা দিতে থাকে সাথে পড়ালেখার অবনতিও। প্রত্যেকদিন কোনোনা কোনো স্যার তাকে মারবেই তার এই পদোন্নোতির জন্য। কিন্তু তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। সে প্রায়ই তার মাকে ফোন করে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফোনে কান্নাকাটি করত। কিন্তু তার মা নিরুপায়, বাবার অনুমতি ব্যতিত তিনি কিছুই করতে পারে্ননা। মা ছেলের দুঃখ বুঝত কিন্তু চাইলেও কিচ্ছুটি করতে পারত না, শুধু নিরবে নিরবে কাদত ছেলের জন্যে।

শেষমেশ রক্তিম ঠিক করল সে নিজেই তার সমস্যার কথা তার বাবাকে বলবে। সে মাকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাল, মা শুনে রাজি হতে চান নি। কারন তিনি জানতেন রক্তিমের বাবা কখনোই তার ছেলের এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না,বরং কিছু অকথ্য ভাষায় কথা শুনিয়ে দিবেন।

হ্যা, ঠিক সেটাই হয়েছে যা যা রক্তিমের মা ভেবে ছিলেন। এরপর রক্তিম আর তার বাবা-মার কাছে কখনো ফোন দেয় নি।
*
আজ দীর্ঘ ৩বছর হয়ে গেছে রক্তিম কোনো ছুটিতে বাসায় যায় নি। রক্তিমের বাবা এই নিয়ে খুব চিন্তিত। আর বাবা হয়েও তেমন খোজ-খবর নেয় নি কিন্তু সেটা তো রক্তিমের ভালোর জন্যেই। কিন্তু যে ছেলে সাপ্তাহের ৭ দিনের ৫ দিনেই তার মার সাথে কথা বলতে চাইত, সে ছেলে আজ তিন বছর হয়ে গেছে ফোন করার পরও বাড়িতে আসতে চাইছে না। এটা কি করে সম্ভব !!

আর রক্তিমের মাও কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। আগে ছেলের একটা ফোন আসলে কেমন যেন পাগলপ্রায় হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর এমন করে না। ঠিক বুঝে ঊঠতে পারছেন না তিনি কি করবেন। না না, আজই ছেলেকে দেখতে যাবেন আর সাথে করে নিয়ে আসবেন ছেলেকে।

*
হঠাত কি মনে করে যেন চেয়ার থেকে পরে যায় রক্তিম। হয়ত চেয়ারটা পিছলে গেছে বারান্দায় জমাট বৃষ্টির পানিতে। চেয়ারটা উঠাতে যাবে ঠিক এমন সময়ই খালেকের ডাক শুনতে পায়। খালেক তার এখন এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছে মানুষ। কারন ওইতো এখন রক্তিমের একাকিত্তের সময় সঙ্গ দিয়ে থাকে।

_দোস্ত আজকা চম্পা আর বিদেশি মাল আনছি এক বোতল, হইবা না তোর?
_আরে হইব না মানে দোওরাইব, কই দে দে!!

রক্তিম এখন এক অদ্ভুত শান্তিতে বিভোর হয়ে আছে। গত দুই বছর ধরেও সে এই শান্তিতেই সাথে নিয়ে আছে। গতকাল রাতে তার বাবা-মার সাথে কথা হয়েছিল। দেখতে আসার কথা বলেছিল তার বাবা কিন্তু সেই কথা তার আর এখন মাথায় নেই।

সে এখন আনমনে শুধু হাসছে আর সেই মরিচাপড়া লোহার গা থেকে চুয়ে পড়া পানির ফোটার হিসেব করছে।কারন রক্তিমের বিশ্বাস তার হিসাব এবার আর ভুল হবে না।
না, কোনোমতেই না !!

Related posts

Leave a Comment